• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ০৭:৫৪:১৬
প্রকাশের সময় :
মার্চ ২৬, ২০২৩,
৩:২০ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মার্চ ২৬, ২০২৩,
৩:২০ অপরাহ্ন

৩৪৫ বার দেখা হয়েছে ।

বিভীষিকাময় গণহত্যা ও স্বাধীনতা

বিভীষিকাময় গণহত্যা ও স্বাধীনতা

বাঙালি জাতি তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর রাত ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ রাতে বাঙালির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে এসেছিল। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মধ্যরাতে। ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপরে তারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্য নিয়ে তারা বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে। পূর্বপরিকল্পিতভাবে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ গণহত্যার এক নীলনকশা অনুযায়ী তারা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটনায়। ‘অপরাশেন সার্চলাইট’-এর নীলনকশায় ঢাকার ৪টি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং তৎকালীন পিলখানা ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)। যার ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে (মধু দা) এবং ২৫ মার্চ গুলিবিদ্ধ হয়ে চারদিন পর মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের মধ্যে ৪৫ জন শহীদ হন। বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৫ মার্চ কালরাত্রি এবং এর পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকা শহরজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে যেটা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশ যেন ঘাতকের উল্লাসের মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। ফিরে দাঁড়ায় বীর বাঙালিরা। রাজারবাগে পুলিশ বাহিনী, পিলখানায় ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্যরা প্রাণপণে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালালেও ভারি অস্ত্রের কাছে তারা টিকতে পারেনি। ক্রমশ পাকিস্তান বাহিনীর নারকীয়তা বাড়ছিল, তার সমান্তরালে বাড়িছিল প্রতিরোধযুদ্ধও। স্বাধীনতার প্রত্যয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কালরাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।’ শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তহাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান কন্টিনেন্টাল হোটেল) সামনে সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদাররা। এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। মাত্র এক রাতে এমন নির্বিচারে গণহত্যার ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন। তাই ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে সরকার থেকে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বর গণহত্যার নজির স্থাপন করে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, যার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। বার্তাটা ছিল এই রকমÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যকে উৎখাত করুন এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
২৫ মার্চ গণহত্যার পর আর বীর বাঙালিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর রাজনৈতিক কর্মী, বাঙালি সেনা আর সাধারণ মানুষের সম্মিলিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধপর্ব। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ ও আকাক্সক্ষার ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, বিপুল প্রাণহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় স্বাধীনতার সূর্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুরু করতে হবে সেই ১৯৪৭ থেকেই, যখন কিনা ইংরেজরা এই দেশের মাটি ত্যাগ করেছিল। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি চলে যাবার আগে এই উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই দেশে বিভক্ত করে যায়। ধর্মভিত্তিক এই বিভাজনে তখন কোনো সমস্যা বোঝা না গেলেও কিছুদিন যেতেই খোলস পাল্টে আসল রূপ ধরা পড়ে যায়। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে শোষণ চালাতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
শুরুটা হয় ১৯৫২-তে ভাষার ওপর আঘাত থেকে। এতেই থেমে থাকেনি তারা, রীতিমত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যখন বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিল রাজপথে, তখন থেকেই বলতে গেলে বাঙালিদের মানসপটে অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল যে, স্বাধিকারই আসল মুক্তি। তাছাড়া এই নিপীড়ন চলতেই থাকবে। এরপর একসময় রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চার ওপর খড়গহস্ত নেমে আসে। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিদের হেনস্তা করতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সরকারি, সামরিক, বেসামরিক সব খাতেই নজির বিহীন বৈষম্যের শিকার হয় বাঙালিরা। মাঝে একবার বাংলাকে উর্দু হরফে লেখার পর্যন্ত চেষ্টা করেছিল তারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস বেশ বর্ণাঢ্য ভাবে উদ্যাপন করা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে উদ্যাপন শুরু হয়। ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের শুভ সূচনা করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন রঙের পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়। জাতীয় স্টেডিয়ামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ, কুচকাওয়াজ, ডিসপ্লে ও শরীরচর্চা প্রদর্শন করা হয়।
‘কী দেখার কথা, কী দেখছি…, তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি …’ স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে গায়ক হায়দার হোসেনের এই গানটিই যেন করুণ সুরে বেজে ওঠে মনের কোণে। তিরিশ চল্লিশ নয়, পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার। সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণ হয়নি আমাদের। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিংসাÍক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। কিন্তু এর মাঝেও আছে খুশির খবর। স্বাধীনতা উত্তরকালে যে দেশকে একদিন কিসিঞ্জার বলেছিল তলাভাঙ্গা ঝুড়ি, আজ সে দেশই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতি ক্রমশ উন্নতির দিকে এবং শুরুর দিকের দৈন্যদশাও ঘুচেছে। তাই আমরা যদি সবাই দেশকে ভালোবেসে দুর্নীতিমুক্ত এই দেশ গড়ার শপথ নিই এবং যে যার জায়গা থেকে কাজ করতে থাকি, তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হবে। এবং সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা পরবর্তী প্রজš§কে উপহার দিয়ে যেতে পারবো আমরা!
স্বাধীনতা দিবস কবে থেকে কার্যকর করা হয়েছে তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই এর উদ্যোগ নেয়া হয়। একদম সঠিক করে বললে, ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি একটি বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়, এবং ২৬ মার্চ এর ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য দিনটিকে সরকারিভাবে ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয় দিবসের মতোই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের অনুভূতিতে স্মৃতির ঝড় বয়ে নিয়ে আসে। অশ্র“, হাহাকার ও ঘৃণিত আর্তনাদের সঙ্গে তা জাগিয়ে তোলে প্রতিশোধের স্পৃহা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা মুক্তিযুদ্ধেরই অর্জন।


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট