• ঢাকা
  • শনিবার:২০২৪:এপ্রিল || ০৮:৪৮:৫৭
প্রকাশের সময় :
জুলাই ১৪, ২০২৩,
২:৫৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
জুলাই ১৪, ২০২৩,
২:৫৯ অপরাহ্ন

৫৬৩ বার দেখা হয়েছে ।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ভার কার

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ভার কার

প্রতিটা রাতের শেষে সূর্য ওঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেকটি কর্মমুখর দিন। শুরু হয় নিরন্তর ছুটে চলা। তারই মাঝে একটু অবসর। একটু অবকাশ নেয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু সেই আনন্দ-বিষাদের মধ্যে হানা দিয়েছে ডেঙ্গু। করোনা ভাইরাসের মতোই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রভাব। মশাবাহিত একপ্রকার ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু। এই জ্বর অন্যান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর থেকে আলাদা। এই জ্বর কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়। এই ভাইরাস জ্বর এককভাবে অথবা অন্যান্য ভাইরাস (চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, বার্মা ফরেস্ট, ফ্লু, রেসপাইরেটরি সিনসাইটিয়াল) ও ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গেও হতে পারে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে সারা দেশে প্রথম মারা যায় ১৬৪ জন লোক। সেই থেকে চলছে এডিশ মশার আক্রমণ। ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব চলা অবস্থায় ২০২০ সালে সারা বিশ্বে হানা দেয় করোনা। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল পুরোটাই ছিল করোনা ভাইরাস মহামারীর দুই বছর। সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস। সেই থেকে এখনও প্রতিদিন করোনা ভাইরাসে মারা যাচ্ছে দুই-একজন রোগী। এখন করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের মতো চলছে ডেঙ্গু জ্বরের মহামারী। সারা দেশে বেড়েছে এর প্রকোপ। করোনা ভাইরাস যদি নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণে আসবে না। শহর থেকে গ্রামেÑ ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। কি করছেন দুই সিটি করপোরেশন তা বোধগম্য নয়।
বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন প্রায় ৬ হাজার রোগী। এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ডেঙ্গুর প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ১ হাজারের বেশি রোগী এবং প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৫ থেকে ৭ জন। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার আক্রমণে এর বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার শেষ নেই। বিপুল অর্থ খরচের পরও কেনইবা কর্তৃপক্ষ এডিস মশার কাছে পরাজয় বরণ করছে; তা নিয়ে হাজারও প্রশ্ন দেশবাসীর। রাজধানী ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফল ভোগ করছে পুরো দেশবাসী।
দেশে জ্যামিতিকহারে বাড়ছে ডেঙ্গু। সরকারি হিসাবেই গেল এক সপ্তাহে (৬-১২ জুলাই) ৫ হাজার ৬৮৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় মারা গেছেন ২৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের মধ্যে ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ৬৬১ জন, শুক্রবার ১৮১ জন, শনিবার ৮২০ জন, রবিবার ৮৩৬ জন, সোমবার ৮৮৯ জন, মঙ্গলবার ১ হাজার ৫৪ এবং বুধবার ১ হাজার ২৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসাপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ৮১২ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন। এমন নাজুক পরিস্থিতিতেও এখনও অনেক হাসপাতালে আক্রান্তদের মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করানো যাচ্ছে না। ডেঙ্গুর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ওয়ার্ড বা কর্নার খোলা হয়নি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, এডিস মশার প্রজনন রুখতে ব্যর্থ, তারা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী। বর্তমানে ঢাকায় মশার প্রজনন বৃদ্ধি বা কমার সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের খামখেয়ালিপনা এবং কর্তব্যে অবহেলাই দায়ী। কোনোভাবেই তারা তাদের এই ব্যর্থতা এড়িয়ে যেতে পারেন না।
২০১৯ সালে মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন লক্ষ করা যায়নি। কার্যকর সুফল পেতে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। যেনতেনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমবে না। পাশাপাশি নগরবাসীকেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক হতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে কাজ করতে হবে। এডিস মশা বা মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সিটি করপোরেশন করতে চায় কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। সিটি করপোরেশন যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, এতে নগরবাসীর কোনো সুফল মিলছে না।
সিটি করপোরেশনকে এখান থেকে বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি হবে না। বর্তমান মশার উপদ্রব বৃদ্ধি বা কমার বিষয়টি প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে মাঝে মাঝে এডিশের প্রজনন বাড়ছে এবং মাঝে মাঝে কমছে। মশার উপদ্রবের কারণে খালি জায়গায় বসার জো নেই। খালি জায়গায় বসলেই চারপাশে মশা এসে শরীরে বসে।
ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সময়টা ডেঙ্গুর প্রজনন বাড়ে। আর এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে, মৌসুমের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অবহিত করা হয়েছিল। এরপরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যকর তৎপরতার কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বছরব্যাপী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার, সিটি করপোরেশনগুলো সেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, ডেঙ্গু সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এটি মোকাবিলায় আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সব দপ্তরকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। যেসব ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই সেখানে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য অস্থায়ী কেন্দ্র করতে হবে। কেউ পজেটিভ হলেই তাকে মশারীর ভিতর রাখতে হবে। বয়স্ক, গর্ভবতী ও শিশু ডেঙ্গু পজিটিভ হলে বেশি ঝুঁকি থাকে। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এক্ষত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দুটি হাসপাতাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশা নিধনে মাঠ পর্যায়ে থেকে শুরু করে প্রত্যেক অলিগলিতে প্রচুর সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী নিয়াগ দিতে হবে। তাদের কীটতত্ত্ববীদ দিয়ে অন্তত দুইদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে জরুরিভিতিত্তে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আক্রান্তদের মশারির মধ্যে রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। টানা পাঁচ বছর এই কার্যক্রম চালাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে মশা বাড়ায় এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কলকাতা সফল হয়েছে। ফলে পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নাতার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে।
গড়ে প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ১ হাজার ২৪৬ জন রোগীর বেশি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। যা চলতি বছরে একদিনে হাসপাতালে সর্বোচ্চ ভর্তির রেকর্ড। এ সময়ে মারা গেছেন পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী। এর আগে মঙ্গলবার একদিনে ডেঙ্গু জ্বরে ১ হাজার ৫৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ সময়ে রেকর্ড সাত জন মারা যান।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১৬ হাজার ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় ১১ হাজার একজন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৫ হাজার ১৪২ জন। একই সময়ে দেশে সর্বমোট ছাড়া পেয়েছেন ১২ হাজার ২৬৪ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত আট হাজার ৪০২ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে তিন হাজার ৮৬২ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদেরকে পরিষ্কার রাখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতায় সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দিকে না তাকিয়ে পাড়া-মহল্লায় তরুণরা দল বেঁধে নিজেরাই নেমে পড়তে হবে আমাদের নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে। সরকার মশা মারবে, টিকা আনবে, হাসপাতাল বানাবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। করোনা ভাইরাস যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুখ-নাক ঢেকে রাখতে হবে। সেই রকম এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের কথা ভেবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট