• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ২২:৩২:২৬
প্রকাশের সময় :
অক্টোবর ৭, ২০২২,
১০:১০ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
অক্টোবর ৭, ২০২২,
১০:১০ পূর্বাহ্ন

৩৬২ বার দেখা হয়েছে ।

টাঙ্গুয়ার হাওর পর্যটনে নতুন ধারা, ভাসছে অর্ধশতাধিক নতুন হাউসবোট

টাঙ্গুয়ার হাওর পর্যটনে নতুন ধারা, ভাসছে অর্ধশতাধিক নতুন হাউসবোট

কোনোটার নাম ‘জলতরঙ্গ’, কোনোটা ‘গল্পতরী’ বা ‘মেঘদূত’। বাহারি নামগুলো সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশেষায়িত নৌযানের, যা পরিচিত ‘হাউসবোট’ হিসেবে। চলতি মৌসুমে এমন অর্ধশতাধিক নতুন হাউসবোট ভেসেছে হাওরের পানিতে। হাউসবোটগুলোর মালিকানা দুই শতাধিক তরুণের।

বিনিয়োগকারী ১০ তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি নৌযান তৈরিতে খরচ হয়েছে ১৮ থেকে ২৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ ১০ কোটি টাকার বেশি।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এই জলরাশি। জলের ওপর মাথা তুলে ভেসে থাকা হিজল-করচ গাছ, পাখির ওড়াউড়ি, অনতিদূরে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়। হাওর ও মেঘ-পাহাড়ের এমন রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রতিবছর হাজারো পর্যটক ঘুরতে যান হাওরে। যাঁদের ঘিরে বিকশিত হচ্ছে নতুন ধারার ‘হাওর-পর্যটন’।

হাওরে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রথম হাউসবোট তৈরি হয় ২০১৯ সালে। ‘জলকুঠি’ নামের হাউসবোটটি তখন তেমন প্রচার পায়নি। ২০২১ সালে ‘টাঙ্গুয়ার অভিযাত্রিক’, ‘বজরা’সহ চারটি নতুন হাউসবোট হাওরে ভাসে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ বিলাসবহুল নৌযানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার পায়। হাওরে পর্যটকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে অন্যরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হন। এর ধারাবাহিকতায় এ বছর অর্ধশতাধিক হাউসবোট হাওরে পর্যটন সেবায় যুক্ত হয়।

আগে হাওর ভ্রমণ ছিল শুধুই রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের জন্য। এখন পরিবার নিয়েও স্বচ্ছন্দে ঘুরতে যাচ্ছেন অনেকে।

এ মাসেই হাউসবোটে পরিবার নিয়ে ঘুরে এসেছেন ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে হাওরের ঐতিহ্যবাহী নৌকায় ভ্রমণ করেছি। প্রচলিত সেসব নৌকায় শৌচাগার বলতে ছিল ছোট একটা খোপ। ঘুমাতে হতো পাটাতনে। আঁটসাঁট নৌকায় চলতে হতো হামাগুড়ি দিয়ে। হাউসবোটে আলাদা কেবিন আছে, ফ্যান আছে, আছে হাইকমোডসহ টাইলস করা বাথরুম।’

 

‘রঙের খেয়া’ হাউসবোটের পরাগ আহমেদ জানান, হাউসবোটগুলো সুনামগঞ্জ সদর ও তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন ঘাট থেকে ছাড়ে। প্রতিটি হাউসবোটের নামে ফেসবুক পেজ আছে। এগুলো বুকিং দিতে হয়। দুই দিন ও এক রাতের জন্য নৌযান ও পর্যটকের সংখ্যা ভেদে জনপ্রতি চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত লাগে। দুই দিনে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার, শহীদ সিরাজ লেক, বারেক টিলা, শিমুল বাগানসহ দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানো হয়।
পর্যটনই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান

নাম তাঁর অপু নজরুল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ভ্রমণের নেশা এই তরুণের। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের স্নাতক অপু ভ্রমণের নেশাটাকে একসময় পেশা হিসেবে নেন। ২০১৬ সাল থেকে দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে ট্যুর পরিচালনা করেন। টাঙ্গুয়ার হাওরেও দল বেঁধে মানুষকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই জায়গা থেকে একজনকে সঙ্গে নিয়ে হাউসবোট বানিয়েছেন। তাঁদের হাউসবোটের নাম ‘জগৎজ্যোতি’।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাসছে একটি হাউসবোট

 

অপু নজরুল বলছিলেন, ‘জগৎজ্যোতি হাউসবোটে আমাদের ১৮ লাখের মতো টাকা খরচ হয়েছে। ভেবেছিলাম, তিন মৌসুমের মধ্যে মূল খরচ উঠে আসবে। কিন্তু এবার আকস্মিক বন্যার কারণে দুই মাস হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে পর্যটক এখনো যথেষ্টই।’

একই রকম গল্প ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সাদিফুজ্জামান দিগন্তের। ভ্রমণের ঝোঁক থেকে ‘ব ট্রাভেলার্স’ নামে পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। দেশে-বিদেশে ভ্রমণ পরিচালনা করেন। টাঙ্গুয়ার হাওরের পাঁচটি নৌকায় তাঁর বিনিয়োগ আছে।

হাউসবোটের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নারীও আছেন। শুধু নারীদের বিনিয়োগে তৈরি হয়েছে একটি হাউসবোট। সাত নারীর সেই নৌযানটির নাম ‘বেহুলা’। তাঁদেরই একজন টুম্পা প্রামানিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সবাই ভ্রমণ সংগঠন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যার সদস্য। বেহুলা মূলত ভ্রমণকন্যারই।’
উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা

প্রতিটি হাউসবোটে সুকানি, পাচকসহ চার–পাঁচজন দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবার যাত্রা শেষে তাঁরা পারিশ্রমিক পান। দুই দিন এক রাতের যাত্রা শেষে প্রত্যেকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে পান। হাউসবোটের এই কর্মীরা সবাই সুনামগঞ্জ সদর ও তাহিরপুর উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা। হাউসবোটগুলো তাঁরাই দেখভাল করে রাখেন।

পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ–সুবিধা আছে হাউসবোটগুলোতে
হাওরে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত বিনিয়োগকারীরা বলছেন, হাওর পর্যটন বিকশিত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। হাওরে ভ্রমণ মৌসুম পাঁচ থেকে ছয় মাস। এ সময় মাসে ১০টি ট্রিপ দিতে পারলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয় একেকজনের। এর বাইরে বকশিশও পেয়ে থাকেন তাঁরা।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, হাওর এলাকার মানুষ দরিদ্র। পর্যটনের মাধ্যমে তাঁদের কর্মসংস্থান হয়েছে। হাউসবোট ও ঐতিহ্যবাহী নৌকা মিলিয়ে অন্তত এক হাজার পরিবার সরাসরি উপকৃত হচ্ছে।

‘জলফড়িং’ নামে একটি হাউসবোটে সুকানির কাজ করেন মো. হাদিস। একসময় দিনমজুরির কাজ করতেন। প্রথম আলোকে হাদিস বলেন, ‘হাওরের মানুষ আমরা। ছোটবেলা থেকে নৌকাতেই বড় হয়েছি। ছেলেসহ এখন হাউসবোটে কাজ করছি। আয় মন্দ না।’
পরিবেশ রক্ষা করে পর্যটন

১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। পরের বছর এটি বিশ্ব ঐতিহ্যর স্বীকৃতি পায়। এর আগ পর্যন্ত এই হাওর জলমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হতো। আধুনিক নৌযানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকের সমাগমও বেড়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এতে হুমকিতে পড়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রাজাই গ্রামের বাসিন্দা এন্ড্রু সলমার বলেন, প্রতিদিন শত শত নৌকা হাওর চষে বেড়ায়। নানাভাবে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন পর্যটন নিয়েই আলোচনা বেশি হচ্ছে। হাওরের পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনায় নেই। পর্যটনকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও হাওরের জীববৈচিত্র্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

গত আগস্টে পর্যটক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ১২টি শর্ত দেয় তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ২টি শর্ত নৌযানের নিবন্ধনসংক্রান্ত এবং বাকি ১০টি পর্যটন পরিবহন ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবির প্রথম আলোকে বলেন, হাউসবোটসহ ১০৯টি নৌযানের নিবন্ধন করানো হয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে করানো হচ্ছে। এটা করার মূল উদ্দেশ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটক ও বোটমালিকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা। তদারকি বেড়ে যাওয়ায় আগে পরিবেশদূষণের যতটা অভিযোগ আসত, এবার অভিযোগ কম আসছে।
তরুণদের পাশে থাকতে হবে

সরকারি ছুটির দিনগুলোতে প্রায় এক হাজার মানুষ টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করেন। কর্মদিবসেও ঘুরতে আসেন অনেকে। সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে পর্যটকবাহী নৌযান টাঙ্গুরার হাওরে প্রবেশ করে। তাই হাওর পর্যটনসহ দেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে তরুণদের উৎসাহিত করতে বলছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃতিনির্ভর পর্যটন জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যার অন্যতম মাধ্যম ‘হাওর পর্যটন’। ঠিকমতো ব্র্যান্ডিং করা গেলে বাইরের পর্যটকও পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, যেসব তরুণ হাওর পর্যটনে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের সহজ শর্তে ঋণসহ সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।