• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৪:এপ্রিল || ১৩:৫৩:৫৮
প্রকাশের সময় :
মে ১৯, ২০২২,
৯:৩৩ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ১৯, ২০২২,
৯:৩৩ অপরাহ্ন

৩৯৭ বার দেখা হয়েছে ।

আনিসুজ্জামান : পুরোনো বাংলা গদ্য বিষয়ে নতুন গবেষণা

আনিসুজ্জামান : পুরোনো বাংলা গদ্য বিষয়ে নতুন গবেষণা

ড. মোহাম্মদ আজম

উনিশ শতকের আগের গদ্যচর্চা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয়। পুরোনো গদ্যের প্রমাণসূচক উপকরণ আবিষ্কার বা নতুনভাবে উপস্থাপনের দিক থেকে আনিসুজ্জামানের লেখালেখির একটি অপূর্ণ তালিকা এরকম : ক) ‘A note on two manuscripts of ‘Sarvodaya’’, [Chittagong University Studies, Part 1, Vol. ii, 1978]; L) Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records, [London, 1981]; খ) ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু বাংলা চিঠিপত্র’, [ভাষা ও সাহিত্য পত্র, ষষ্ঠ বর্ষ, ১৩৮৫; গ) ‘আঠারো শতকের একটি মামলার নথি’, সাহিত্য পত্রিকা, বর্ষা, ১৩৮৯; ঘ) আঠারো শতকের বাংলা চিঠি [চট্টগ্রাম, ১৯৮২]

এর মধ্যে স্বরোদয়-সংক্রান্ত গবেষণার বিশেষ গুরুত্ব এই যে, এর মধ্য দিয়ে ‘ষোড়শ শতাব্দীর রচনা বলে নিঃসংশয়ে গণ্য হতে পারে, এমন একটি গ্রন্থের সন্ধান’ পাওয়া গেছে। ফ্যাক্টরি করেসপন্ডেন্স (Factory Correspondence) ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির বাংলা নথিপত্রের ব্যবহারযোগ্য সুশৃঙ্খল তালিকা করে অন্য অনেক গবেষণার পথনির্দেশ করেছে।

আঠারো শতকের মামলার নথি – আমরা পরে দেখব – সমকালীন চালু বাংলার কেজো রূপের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে তার সংগৃহীত উপাদান রাশির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একরাশ বাণিজ্যিক চিঠির সংকলন। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত দুই হাজারের বেশি বাণিজ্যিক পত্র খুঁজে পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। সেখান থেকে নির্বাচিত চিঠি প্রকাশ করেছিলেন আঠারো শতকের বাংলা চিঠি নামে।

পুরোনো বাংলা চিঠিপত্রের তাৎপর্যপূর্ণ সংকলন আগে প্রকাশ করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ সেন (১৯৪২) এবং পঞ্চানন মণ্ডল (১৯৫৩)। বিশ শতকের আশির দশকে প্রকাশিত হলো আরও দুই গ্রন্থ। আঠারো শতকের বাংলা চিঠি ছাড়াও এ ধরনের আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন দেবেশ রায়।

ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত দুই হাজারের বেশি বাণিজ্যিক পত্র খুঁজে পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। সেখান থেকে নির্বাচিত চিঠি প্রকাশ করেছিলেন আঠারো শতকের বাংলা চিঠি নামে।
প্যারিসের ‘বিবলিওথেক ন্যাশিওনেল’ থেকে পাওয়া অসাঁর সংগ্রহের অনেকগুলো চিঠি সম্পাদনা করে তিনি বের করেছেন আঠারো শতকের বাংলা গদ্য (১৯৮৭)। আনিসুজ্জামান (১৯৮৪: ৩২) মনে করেন, আদর্শ নমুনাপত্র হিসেবে এগুলো লিখিত হয়েছিল। পারিবারিক চিঠি ছাড়াও এতে বৈষয়িক চিঠি আছে, নানারকম দলিলের নমুনাও আছে।

‘প্যারিসে রক্ষিত এই দুই খ-ই সম্ভবত আদর্শপত্র ও দলিল লিখনপ্রণালীর প্রাচীনতম নমুনা’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৩৩)। পুরোনো চিঠিপত্র ও দলিলাদির এই সংকলনগুলোর মধ্যে আনিসুজ্জামানের সংকলন একদিক থেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল। কারণ এগুলো ব্যক্তিগত রচনা নয়, তত্ত্বচর্চা নয়, এমনকি আদর্শ রচনারীতিও নয়। এগুলো একেবারেই মেঠো কাজে ব্যবহৃত ভাষার লিখিতরূপ। এই ধরনের নমুনার উপর ভিত্তি করেই দেবেশ রায়ের (১৯৮৭) অনুমান করা সম্ভবপর হয়েছে যে, প্রাক-ব্রিটিশ এই গদ্যই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কথিত ‘বিষয়ী লোকে’র ভাষা। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৮৮ বঙ্গাব্দে শাস্ত্রী লিখেছেন—

‘আমাদের দেশে সেকালে ভদ্রসমাজে তিন প্রকার বাংলা ভাষা চালু ছিল। মুসলমান নবাব ও ওমরাহদিগের সহিত যে-সকল ভদ্রলোকের ব্যবহার করিতে হইত, তাঁহাদের বাংলায় অনেক উর্দু শব্দ মিশানো থাকিত। যাঁহারা শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহাদের ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হইত। এই দুই ক্ষুদ্র সম্প্রদায় ভিন্ন বহু সংখ্যক বিষয়ী লোক ছিলেন। তাঁহাদের বাংলায় উর্দু ও সংস্কৃত দুই মিশানো থাকিত। কবি ও পাঁচালিওয়ালারা এই ভাষায় গীত বাঁধিত। মোটামুটি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, বিষয়ী-লোক ও আদালতের লোক এই তিন দল লোকের তিনরকম বাংলা ছিল। বিষয়ী লোকের যে বাংলা তাহাই পত্রাদিতে লিখিত হইত এবং নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ঐরূপ বাংলা শিখিলেই যথেষ্ট জ্ঞান করিত।’ (হরপ্রসাদ ২০০০/বি: ৫৬২)

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দূরদর্শী মেধাবী অনুমানে যা ছিল, আনিসুজ্জামানদের গবেষণায় তার প্রত্যক্ষ নজির মিলল।

২.

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পুরোনো বাংলা গদ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, তার ভাষায়, ‘সবিরাম প্রায় দশ বছর’। এর মধ্যে তার নিজের উপকরণগত সংযোজন সম্পর্কে উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন ১৯৮৪ সালে। বাংলা একাডেমি বক্তৃতামালার প্রথম বক্তারূপে আহূত হয়ে তিনি ১৬, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারিতে তিনটি লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন।

ওই বছরই বাংলা একাডেমি থেকে এগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে পুরোনো বাংলা গদ্য নামে। নিজের আবিষ্কৃত উপকরণের সাথে অন্যদের বিপুল তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে তিনি একদিকে পুরোনো গদ্যের ধারাবিবরণী তৈরি করেছেন, অন্যদিকে বিবেচনা ও মূল্যায়নের এমন কিছু পথনির্দেশ করেছেন, যা আগে অতটা সুলভ ছিল না।

পুরোনো চিঠিপত্র ও দলিলাদির এই সংকলনগুলোর মধ্যে আনিসুজ্জামানের সংকলন একদিক থেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল। কারণ এগুলো ব্যক্তিগত রচনা নয়, তত্ত্বচর্চা নয়, এমনকি আদর্শ রচনারীতিও নয়।
শ’ খানেক পৃষ্ঠার বইটিতে ‘প্রস্তাব’, ‘উপকরণ’, ‘বিকাশ’ ও ‘বিস্তার’ নামের চারটি অধ্যায় আছে। ‘প্রস্তাব’ অংশের শেষ বাক্যগুলো এরকম, ‘নতুন দিনের সমারোহ পুরোনোকে সহজেই ভুলিয়ে দিল। এমন করে ভুলিয়ে দিল যে, নতুন দিন যে প্রথম দিন নয়, সেকথা এখন নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’ কাজটা বইয়ের বাকি অংশে ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

এই বইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক নিশ্চয়ই ধারাবিবরণী তৈরি। আনিসুজ্জামান ঐতিহাসিক গবেষণায় নিরাসক্ত থাকতে পারেন, যথেষ্ট প্রমাণ না মিললে আবেগ তাড়িত সিদ্ধান্ত নেন না, প্রায় সর্বার্থেই অতিশয়োক্তি পরিহার করে চলেন। ফলে বাজারে চালু তথ্য-উপাত্ত থেকে তিনি কীভাবে পছন্দসই তথ্য নির্বাচন করেছেন, বিতর্কিত বিষয়গুলোতে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা খতিয়ে দেখার বিশেষ গুরুত্ব আছে। আমরা এখানে বিশেষভাবে নজর দেবো তার বিশ্লেষণ পদ্ধতির আরেকটি দিকে। দেখা যাবে, তিনি চালু অভিযোগগুলোর জবাব দেওয়ার ভঙ্গিতে বিশ্লেষণে অগ্রসর হয়েছেন। যেমন, পুরোনো গদ্যের বিষয়গত সংকীর্ণতা সম্পর্কে চালু মত খণ্ডন করে লিখেছেন, ‘ষোল থেকে আঠারো শতক অবধি বাংলা গদ্যের নিদর্শন প্রধানত চিঠিপত্রে ও দলিল-দস্তাবেজে আবদ্ধ, এই প্রচলিত ধারণা এখন সংশোধনের যোগ্য। ধর্মবোধকে আশ্রয় করে সেযুগে যেমন কাব্যসৃষ্টি হচ্ছিল, তেমনি, পরিমাণে অপেক্ষাকৃত কম হলেও, গদ্যচর্চা চলছিল ধর্মসাধনার তত্ত্বগত দিক নিয়ে। এরই ফলে বৈষ্ণব সাধন তত্ত্বঘটিত নিবন্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মমতের ব্যাখ্যা এবং শ্রাদ্ধবিধি ও নিগমকথা সম্পর্কে গদ্যরচনা পাই। অন্যদিকে ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষ ও চিকিৎসা-বিষয়ক রচনা থেকে এও প্রমাণিত হয় যে, গদ্যচর্চা শুধু ধর্মবিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না।’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৭৩)

পুরোনো গদ্য জটিল এবং দুরূহ—এই ধরনের চালু ধারণার অযৌক্তিকতা নানাভাবে দেখিয়েছেন আনিসুজ্জামান। ১ বৈশাখ, ১১৮৮ সালের এক চিঠি উদ্ধৃত করে লিখেছেন,

‘যতিচিহ্ন বসিয়ে নিলে ধরা পড়বে যে, এর ভাষা সরল, বাক্য ছোট। বৈষ্ণব নিবন্ধে যে সরল বাক্যপ্রবাহ আমরা দেখেছি, তার সঙ্গে এর তুলনা চলে। … আবার সাধারণ লোকের মধ্যে সম্পাদিত দলিল-দস্তাবেজে ব্যক্তিগত পত্রের মতোই এই সরল ও প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি দেখা যায়।’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৮০)

আরও আগে ১৯৮২ সালের বইতে ঢাকার কুঠি থেকে প্রেরিত পত্র প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘সমসাময়িক ব্যক্তিগত পত্রে এমন অলংকৃত পাঠ তো পাওয়াই যায় না, বরঞ্চ আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্রেও অনেক সময় কুঠির চিঠির মতো সরল পাঠ পাওয়া যায়। অলংকৃত ও সহজ পাঠের রেওয়াজ দুই যে পাশাপাশি চলে এসেছে অনেককাল ধরে, তা সহজেই বোঝা যায়। পাঠ ও স্বাক্ষরের অংশ ছাড়া কিছু চিঠির ভাষা আটপৌরে বাংলা, কিছু চিঠিতে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি শব্দ বহুল ব্যবহৃত, কিছু চিঠিতে আঞ্চলিক শব্দেরও মিশেল আছে। আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি শব্দ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়ের অনুরোধে সন্নিবেশিত হয়েছে।’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮২: ৪)

তবু আজকের পাঠকের কাছে ওই গদ্য জটিল ও দুর্বোধ্য মনে হয় কেন, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন আনিসুজ্জামান (১৯৮৪)। তখন যতিচিহ্নের প্রচলন হয়নি। পদবিন্যাসও আলাদা ছিল। তাছাড়া তিনি লিখেন, ‘ঐ পারিভাষিক শব্দগুলোর সঙ্গে এখন আমাদের যোগ রহিত হয়ে গেছে। সতেরো-আঠারো শতকে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। যতিচিহ্নের অভাব কাউকে পীড়িত করত না। বাক্যের প্রথমাংশে সমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করে পরবর্তী অংশে অসমাপিকা ক্রিয়ার প্রয়োগ চলত। পারিভাষিক শব্দও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অপরিচিত শব্দ ছিল না। পারিভাষিক শব্দ ছাড়াও বহু আরবি-ফারসি-হিন্দি এবং আঠারো শতকের শেষে কিছু ইংরেজি শব্দ ভাষায় গৃহীত হয়েছিল। ঢাকা কুঠির চিঠিপত্রে এরকম শতাধিক শব্দ পাওয়া যায়, যা এখন আমরা ভাষায় ব্যবহার করি না। কিন্তু এসব শব্দ তখন অপণ্ডিতেরাই ব্যবহার করেছিলেন। সুতরাং এর অর্থ জ্ঞাপনে ও গ্রহণে অসুবিধে হতো বলে মনে হয় না।’(আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৮২-৮৩)

অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই গদ্য ছিল সমকালীন চলতি বাংলার খুবই কাছের। ১৭৯৫ সালের এক নথি থেকে লম্বা উদ্ধৃতি দিয়ে আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘সওয়াল-জবাবের যে বিবরণ আছে, তাতে তখনকার কথ্য-বাংলার পরিচয় ধরা পড়েছে বলে মনে করি। … মুখের কথা হয়তো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ না করে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখানেও বাক্যের সংক্ষিপ্ততা এবং প্রকাশের সারল্য বাংলা গদ্যের মূল প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৮৬-৮৭)

নিপুণ তথ্যবিন্যাস এবং বলিষ্ঠ বিবৃতির মধ্য দিয়ে এভাবে পুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ে বাংলা গদ্যের এমন এক দৃঢ় ভিত্তির খবর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যার ভিত্তিতে যে কোনো নতুন অভিযান সম্ভব ছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ঘটনা সেরকম ঘটেনি। উপনিবেশ আমলে নতুন কর্তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ নতুন গদ্য তৈরি হয়েছিল। তাতে অবশ্য এই গ্রন্থকার বিশেষ উদ্বিগ্ন নন। তিনি নতুন গদ্যের দিগ্বিজয় সম্পর্কে জানেন। ফলে সংবাদটি সবিস্তার পরিবেশন করার দায়িত্বই তিনি পালন করেন, সে ‘যাত্রায় অনেক বিত্ত সংগৃহীত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের অনেকদিনের সঞ্চয়ও হারিয়ে গিয়েছিল’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪: ৮৯)। আনিসুজ্জামানের বইটি আসলে এই ‘ঘরের সঞ্চয়ে’র নির্ভরযোগ্য পরিচয়।

৩.

পুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ের ‘নিবেদন’ অংশটি বিশেষভাবে কৌতূহলোদ্দীপক। এখানে বেশ কয়েকটি দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম আছে, দেশি-বিদেশি বহুজনের কাছে কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি আছে। এই তালিকা একটি সজীব প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ধারার প্রমাণ দেয়। বোঝা যায়, গবেষণাক্ষেত্র হিসেবে প্রাচীন বাংলা গদ্যের একটা প্রবহমানতা ছিল।

আনিসুজ্জামান তাতে অংশ নিয়েছেন এবং একজন কুশলী গবেষক হিসেবে নিজের অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। একাধিক ভাষায় পাণ্ডিত্য, বাংলার পুরোনো ইতিহাসে দখল এবং গবেষকের নিষ্ঠা ছিল তার মূলধন। এই পুঁজি নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গবেষণা প্রবাহে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন এবং কালক্রমে উপকরণ সংগ্রহ ও সামগ্রিক মূল্যায়নের দিক থেকে সাফল্য পেয়েছেন। দুনিয়া জুড়ে এবং এমনকি কলকাতায়ও বহু বইয়ের শুরুতে আমরা এই ধরনের উৎপাদন পদ্ধতি দেখে থাকি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার এই ধরনের দৃষ্টান্ত খুব সুলভ নয়।

ভাবাদর্শিকভাবে স্পর্শকাতর কোনো কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার বাদ দিলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ প্রকল্পটিকে আমরা সুলিখিত-সুসম্পাদিত প্রকল্প হিসেবেই পাবো।
আমাদের আলোচ্য রচনাগুলো সাক্ষ্য দেয়, গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামান আমূল পরিবর্তনবাদী বা বিপ্লবী নন। তিনি বৃহত্তর অর্থে স্থিতির পক্ষে বা প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর অনুকূলেই কাজ করেন। দুটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। পুরোনো বাংলা গদ্যের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শুরুতেই শূন্যপুরাণ এবং সেকশুভোদয়ার কথা আছে।

তিনি সঙ্গত কারণেই বলেছেন, এই দুটি বই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। তিনি অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে প্রধান মতগুলোর উল্লেখ করেছেন এবং নিজের পক্ষপাত কোনদিকে তা স্থির করে জানিয়েছেন। ঠিকই আছে। কিন্তু এই দুটি টেক্সটের কাল ও ভাষা নির্ণয় নিয়ে যে ‘বাগবিতণ্ডা’, তা মোটেই নিরীহ ব্যাপার নয়।

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের আরও দশ সিদ্ধান্তের সাথে এর গভীর যোগ আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, ‘মধ্যযুগে’র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যে ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’, তার সাথে এই বিতণ্ডা সম্পর্কহীন নয়। এই সম্পর্কের উল্লেখ করলে আনিসুজ্জামানের বিবরণী যে অন্যরকম হতো তা নয়; কিন্তু বলার কথাটা হলো, তিনি ‘মূলধারা’র ইতিহাসকে কোনো প্রকার চাপে না ফেলে বিবরণী তৈরি করেছেন, করতে পেরেছেন।

দ্বিতীয় উদাহরণ অবশ্য অতটা নির্দোষ নয়। এই উদাহরণে দেখা যাবে, তার সামগ্রিক প্রকল্পের জন্য প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত পরিভাষার যতটা বাইরে যাওয়া উচিত ছিল, ততটা না যাওয়ায় একদিক থেকে তার প্রকল্পের ক্ষতি হয়েছে। কথাটা গদ্যের বা ‘আদর্শ বাংলা গদ্যে’র সংজ্ঞায়ন-সম্পর্কিত। বারবার তিনি লিখেছেন, অমুক উদাহরণে ‘আঞ্চলিক’ টান দেখা যায়; কিংবা অমুক উদাহরণে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিষয়ের অনুরোধে এসেছে।

আপাতদৃষ্টিতে এই ধরনের উল্লেখ ঠিকই আছে। কিন্তু গভীরভাবে বিচার করে দেখলেই বোঝা যাবে, এই ধারণাগুলো উনিশ-শতক ও তৎপরবর্তীকালের, এবং পূর্ববর্তী গদ্যের আলোচনায় কালাতিক্রমী দোষযুক্ত হয়ে প্রযুক্ত হয়েছে। কারণ, ‘আঞ্চলিক’-এর ধারণা মান বা প্রমিতের ধারণার সাথে সম্পর্কিত একটি ‘অপধারণা’, এই অর্থে যে, মান বা প্রমিত নিজেই আঞ্চলিক বা উপভাষা মাত্র।

বাংলায় মান বা প্রমিতের বর্তমান রূপটি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আগে বিকশিত হয়নি। অন্যদিকে, যদি বলা হয়, আরবি-ফারসি বিষয়ের অনুরোধে ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত ওই কথারই প্রতিধ্বনি করা হয় যে, আরবি-ফারসি শব্দ ‘মূল’ বাংলা ভাষার অংশ নয়। এই ধারণা শুধু ভাষাবিজ্ঞান বা বাংলা ভাষার ইতিহাস বিরোধী নয়, পুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ের প্রকল্পেরও বিরোধী। কারণ, এখানে অন্তত আঠারো শতকের ‘মান’ বাংলার যেসব উদাহরণ আছে, তা আরবি-ফারসি শব্দে সমাকীর্ণ।

এই ধরনের ভাবাদর্শিকভাবে স্পর্শকাতর কোনো কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার বাদ দিলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ প্রকল্পটিকে আমরা সুলিখিত-সুসম্পাদিত প্রকল্প হিসেবেই পাবো। বিবরণীর নির্ভরযোগ্যতা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার দিক থেকে এর সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য দিক। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

ষোল শতকের গদ্য-নমুনার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সতেরো শতকে লিপিকৃত বৈষ্ণব নিবন্ধের যেসব পাণ্ডুলিপি আমরা পাই, তার কিছু-কিছু ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত হয়ে থাকবে। তবে তার কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে না থাকায় এই বিষয়ে আমরা কিছু বলব না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর রচনা বলে নিঃসংশয়ে গণ্য হতে পারে, এমন একটি গ্রন্থের সন্ধান আমরা পেয়েছি।’

এই যে প্রমাণের ব্যাপারে নিঃসংশয় হওয়া এবং তারপর তা উপস্থাপন করা, পুরো বিবরণীতে এই ধারা রক্ষিত হয়েছে। ফলে এ আলোচনা শিথিল মন্তব্য এবং আরোপিত সিদ্ধান্ত থেকে মোটামুটি মুক্ত।

আনিসুজ্জামানের সংশ্লিষ্ট রচনাগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য গদ্যের পরিচ্ছন্নতা এবং সুমিতি। পরিচ্ছন্নতা আসে চিন্তার পষ্টতা থেকে। আর সুমিতি আসলে সুরুচি এবং সুবোধের সহোদর। পরিমিতি, স্পষ্টতা ও যথার্থতার জন্য বক্তা এবং লেখক আনিসুজ্জামানের খ্যাতি আছে। এই লেখাগুলোতে সে খ্যাতি পূর্ণ মাত্রায় রক্ষিত হয়েছে।

উল্লেখপঞ্জি—

* আহমদ ছফা ২০০০, যদ্যপি আমার গুরু, তৃতীয় মুদ্রণ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা

* আনিসুজ্জামান ১৯৮২, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, বাংলা সাহিত্য সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

* আনিসুজ্জামান ১৯৮৪, পুরোনো বাংলা গদ্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

* দেবেশ রায় ১৯৮৭, আঠারো শতকের বাংলা গদ্য, প্যাপিরাস, কলকাতা

* পবিত্র সরকার ১৯৯২, ‘বাংলা গদ্য: রীতিগত অনুধাবন’, বাংলা গদ্যজিজ্ঞাসা, ৩য় মুদ্রণ, অরুণকুমার বসু সম্পাদিত, সমতট প্রকাশন, কলকাতা

* সজনীকান্ত দাস ১৩৫৩, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: গদ্যের প্রথম যুগ, মিত্রালয়, কলকাতা

* হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ২০০০/বি, রচনা-সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, ২য় মুদ্রণ, সত্যজিৎ চৌধুরী, দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, নিখিলেশ্বর সেনগুপ্ত ও সুমিত্রা ভট্টাচার্য সম্পাদিত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা

* De, Sushil Kumar 1962, Bengali literature in the nineteenth century (1757-1857), 2nd edition, Firma K. L. Mukhopadhyay, Calcutta

ড. মোহাম্মদ আজম ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়