• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার:২০২৪:মার্চ || ১৮:৫২:১২
প্রকাশের সময় :
অক্টোবর ৭, ২০২২,
৯:২১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
অক্টোবর ৭, ২০২২,
৯:২১ অপরাহ্ন

৪৩৩ বার দেখা হয়েছে ।

অবৈধ ওয়েবিল ও বাড়তি ভাড়ায় দিশেহারা যাত্রী

অবৈধ ওয়েবিল ও বাড়তি ভাড়ায় দিশেহারা যাত্রী

করোনার ধাক্কা মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সারা বিশ্বে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে বর্তমান সরকার। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় বাস ভাড়া।

এরই মধ্যে ২৯ আগস্ট রাতে জ্বালানির তেল লিটারপ্রতি ৫ টাকা করে দাম কমায় সরকার; কিন্তু বাস ভাড়া কমায়নি বাস মালিকরা। বরং রাজধানীতে চলাচলরত গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য চলছেই। সেই সঙ্গে অবৈধ ওয়েবিল তো আছেই। রাজধানীর প্রতিটি রুটে এখন আধা কিলোমিটার পরপরই অবৈধ ওয়েবিল বসিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বাসের মালিক-শ্রমিকরা মনগড়াভাবে ভাড়া আদায় করছে। অথচ সরকার থেকে এই অবৈধ ওয়েবিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কে শোনে কার কথা? আসলে কার নির্দেশে চলছে এই অবৈধ ওয়েবিল বাণিজ্য; যার কারণে অবৈধ ওয়েবিল ভাড়ায় যাত্রীরা দিশেহারা।

আমাদের দেশে তেলের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ভাড়া। নির্ধারিত ভাড়ারও কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাসের শ্রমিকরা। সরকার বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে কখনই বাস মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে বাসের মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে আজ সাধারণ মানুষ জিম্মি।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে প্রতিদিন ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য হচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরে রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) যাত্রী কল্যাণ সমিতি একটি সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঢাকার গণপরিবহনে প্রতিদিন ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে জানায়।

মিরপুর সাড়ে ১১ অনিক প্লাজা থেকে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। যেখানে বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া আসে ৩৪ টাকা ৩০ পয়সা। তবে এই গন্তব্যে ৩৮ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন চালকের সহকারীরা। মিরপুর সুপার লিংকের চালকের সহকারী বাপ্পী বলেন, আজিমপুর রুটে কোনো ভাড়া কমেনি, ভাড়া কমবে কেন?

বিহঙ্গ পরিবহনের চালকের সহকারী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যাত্রীরা ভাড়া কম দিতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, এবার ভাড়া নিয়ে একটু বেশি ঝামেলা হচ্ছে। যারা বোঝেন তারা ঠিক ভাড়া দিচ্ছেন। যারা বোঝেন না তারা ভাড়া কমেছে বলে বাসে ঝামেলা করছেন। তার মতে, ভাড়া আরো বাড়ানো দরকার, কেননা ৩৪ টাকা তেলের দাম বাড়ানোর পরে নির্ধারিত বাসভাড়ার চেয়েও ১০ থেকে ১৫ টাকা করে বেশি যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে বাস শ্রমিকরা। বাস শ্রমিকদের কাছে সরকারি ভাড়া নির্ধারিত কাগজ দেখতে চাইলে তারা বলেন, কিসের চাট, কিসের কাগজ। কোনো কাগজ-টাগজ নাই। তাদের চাহিদামতো ভাড়া না দিলেই যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন তারা।

যাত্রীরা বলছেন, মালিকের দোহাই দিয়ে চালক-শ্রমিকরা তাদের গলা কাটতে চাচ্ছেন। মিরপুরের বাসিন্দা মুনতাসির বলেন, সরকার বলেন সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তা না হয় মানলাম। কিন্তু আবার বলা আছে, কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া হবে। দূরে যেতে গেলে তারা আবার কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নেবে না। তখন তারা নেবে ওয়েবিল হিসেবে। ওরা আসলে কোনটা ধরে ভাড়া নিচ্ছে- এটাই আমরা বুঝতে পারি না।

মিরপুর-১২ থেকে মাটিকাটা ইসিবি পর্যন্ত চার কিলোমিটারে ১০ টাকা ভাড়া হয়। অথচ ওই রুটে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ২৫ টাকা। ওয়েবিল নিষিদ্ধ হলেও সেই অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সরকারের বাসভাড়া সমন্বয়ের সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না যাত্রীরা। তারা বলেন, কোনো রুটেই ভাড়া কমেনি। ভাড়া কীভাবে সমন্বয় হলো? সামান্য হলেও এতে আসলে পরিবহন মালিকদের সুবিধা হলো। যাত্রীদের কোনো উপকার হয়নি। মতিঝিলগামী যাত্রী আসাদ রহমান বলেন, পাঁচ পয়সা কমানোর কোনো দরকার ছিল না। এ সিদ্ধান্তে গণপরিবহণে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।

গণপরিবহণে প্রতারণার নাম ওয়েবিল। ওয়েবিলের নাম করে অযথা বেশি ভাড়া আদায় ও সময়ক্ষেপণ করেন গণপরিবহণের চালক ও কর্মচারীরা। প্রতারণার মাধ্যমে ওয়েবিলের নামে টাকা বেশি নেওয়ায় নিয়মিতই যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যাত্রাপথে বারবার বাস থামিয়ে ওয়েবিল নামক কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া যেন এক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। তবে বাস মালিক সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওয়েবিল নামক যন্ত্রণার পদ্ধতি বন্ধ ঘোষণা করলেও রাজধানীর কোনো রুটেই এ পদ্ধতি এখনো কার্যকর হয়নি। মালিক সমিতি অবশ্য ঘোষণার পর থেকে বন্ধ কার্যক্রমে তেমন কোনো তদারকিও করছে না। যাত্রী হয়রানি ও বাস ভাড়া বেশি নেওয়ার এ প্রতারণার ওয়েবিল কার নির্দেশে এখনো চলছে এই প্রশ্ন এখন সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়েবিলে যখন গণপরিবহন চলাচল করে তখন নির্দিষ্ট বাস স্টপেজের জন্য তাদের নির্ধারিত ভাড়া দিতে হয়। পরবর্তী স্টেশনে নামলে বা ওয়েবিল যেখানে চেক করা হয় তারপর নামলেই বেশি ভাড়া দিতে হয়। আগে বাসে উঠে চেকাররা বাসের যাত্রী গণনা করত, এখন বাস থামানোর পর রাস্তার পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা চেকারদের কাছে ওয়েবিলের কপি নিয়ে যেতে হয়। সেখানে তারা স্বাক্ষর করলে বাস ছাড়া হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।

কিছুক্ষণ পরপরই চেকার উঠে গাড়ির যাত্রী গণনা করেন এবং ওয়েবিলে স্বাক্ষর করেন। এই ওয়েবিলে স্বাক্ষরের বিনিময়ে তিনি ১০ টাকা করে হেলপারের কাছ থেকে নেন। আর এই টাকা প্রতি ট্রিপে কয়েক স্থানে দিতে হয়। এতে নিদিষ্ট গন্ত্যব্যে যেতে যাত্রী প্রতি নেওয়া হয় বেশি ভাড়া। কারণ ওয়েবিল চেকারের কোনো নির্ধারিত বেতন নেই। বাসের যাত্রী চেক করার পর যে ১০ টাকা নেন সেটাই তার পারিশ্রমিক। এভাবে চেকাররা তার নিদিষ্ট কোম্পানির বাস থেকে ওয়েবিলের নামে টাকা তোলেন। আর এই টাকা সাধারণ যাত্রীদের পকেট থেকেই নেওয়া হচ্ছে। এতে যাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে বলে জানান তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ওয়েবিল চেকার বলেন, বাস মালিকদের সিদ্ধান্তেই আমরা কাজ করছি। আমাদের নির্ধারিত বেতন নেই। বাস থেকেই বেতনের টাকা তুলতে হয়। চেকিং পয়েন্টের পরে নামলে ১০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া বেশি দিতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা শুধু যাত্রীর হিসাব রাখি। ভাড়া কম বেশি নেওয়া চালক হেলপারের কাজ। নির্ধারিত কোম্পানির বাস দেখাশোনার জন্য আমরা রাস্তায় কাজ করছি। বাসে কতজন যাত্রী আছে, কতক্ষণ পর আসছে- এসব দেখাশোনা করতে হয়। এজন্য গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ২০১১ সালে একবার দুই পয়সা কমানো হয়েছিল বাসভাড়া। আবার ২০১৬ সালে তিন পয়সা কমানো হয়েছিল। সেটার প্রভাব সড়কে ছিল না। এবারো পাঁচ পয়সা কমানো হয়েছে। যেখানে এক টাকাই খুঁজে পাওয়া যায় না সেখানে পাঁচ পয়সা কমানো যাত্রীদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই না।

বাস ভাড়া বৃদ্ধি হওয়ায় যাত্রীদের মাথায় চাপল বাড়তি খরচের বোঝা। গণপরিবহণে চলছে এখন লুটপাটের মতো অবস্থা। যে যার মতো করে ভাড়া আদায় করছে। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই মানছে না বাস শ্রমিকরা। বাসের নৈরাজ্য যেন থামছেই না। তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে- এটা ভাবার দায়িত্ব কার? সবমিলিয়ে এক হাঁসফাঁস অবস্থা। এর দায়ভার কে নেবে? কে শুনবে সাধারণ যাত্রীদের দুর্দশার কথা। কে করবে এর সমাধান? সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী বিষয়টা নিয়ে একটু ভাববেন?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট