
নারায়ণগঞ্জের তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরনের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ৩৪ জন মুসল্লি নিহতের ঘটনার দু’বছর পার হলেও বিচার কার্য এগুচ্ছে ধীরগতিতে। সেদিনের বিস্ফোরণের মর্মান্তিক ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়া হলেও স্থায়ী কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই আজও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এবছর ৪ সেপ্টেম্বর ছিলো মর্মান্তিক ঐ ঘটনার দু’বছর। অভিযোগ উঠেছে বিচারকার্য ধীর গতিতে এগুচ্ছে।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এশার নামাজের সময় মসজিদে লিকেজের জমাট গ্যাস ও বিদ্যুতের শর্টসার্কিট স্পার্ক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আহত ৩৭ জনের মধ্যে মারা যায় ৩৪টি তাজা প্রান। মাত্র ৩জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন।
সেদিনের সে ঘটনায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ শেষ করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও স্থানীয় জনসাধারণ।
মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলা ও গাফিলতি, গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস লাইন স্থাপন ও স্থানান্তরের ঘটনাকে দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তদন্ত শেষে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর ২৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয়া হয়। পরে সরকারি অনুমোদন নিয়ে তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অভিযোগ পত্রে যুক্ত করা হয়। মামলাটিতে মোট ৩৭ জনকে আসামি করা হয়। সেদিন তল্লা মসজিদে এশা নামাজ পড়তে এসে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আগুনে ঝলসে গিয়েছিলেন অনেক ধর্মপ্রান মুসল্লি। সেদিনের সে ঘটনায় শিশুসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়।
বহুল আলোচিত এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় নিহতদের তালিকায় রয়েছেন, পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও তার ছেলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন (১৬), মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান (৫০), ইমরান (৩০), আবুল বাশার (৫১), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), জেলা প্রশাসনের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শামীম হাসান (৪৫), স্থানীয় ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ নাদিম হোসেন (৪৫), তল্লার বাসিন্দা নূর উদ্দিনের বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাব্বির (২১) ও মেজ ছেলে তোলারাম ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র জোবায়ের (১৮), জুলহাস উদ্দিন (৩০), মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাটবুকদিয়া গ্রামের কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পোশাক শ্রমিক জুলহাস ফরাজীর ছেলে জুবায়ের ফরাজী (৭), পটুয়াখালীর গলাচিপার আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. রাশেদ (৩০), পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৭২), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী গ্রামের জামাল আবেদিন (৪০), পোশাক শ্রমিক ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন (১২), ফতুল্লার মো. জয়নাল (৩৮), লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুকপলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. নয়ন (২৭), ফতুল্লার ওয়ার্কশপের শ্রমিক কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), শ্রমিক মো. রাসেল (৩৪), বাহার উদ্দিন (৫৫), নিজাম ওরফে মিজান (৪০), আবদুস সাত্তার (৪০), শেখ ফরিদ (২১), নজরুল ইসলাম (৫০), ফতুল্লার নিউ খানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে রিফাত (১৮)।
সেদিনের বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলার সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) আসাদুজ্জামান বলেন, মামলাটি বিচারের জন্য তদন্ত শেষে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছিল। তবে সেখানে আটজন আসামির নাম বাদ পড়েছিল। পরে উচ্চ বিজ্ঞ আদালত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে দাখিলের আদেশ দেন। নিম্ন আদালত তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। এখন মামলাটি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। যাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছিল তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফতুল্লার তল্লাস্থ বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজরত অবস্থায় মসজিদে অভ্যন্তরে তিতাসের লিকেজ হতে নির্গত জমে থাকা গ্যাস ও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে করে মসজিদের ভেতরে থাকা ধর্মপ্রান মুসুল্লিদের শরীর ঝলসে যায়। কারও কারও শরীরে কোনো কাপড়ই ছিল না পুরোপুরি ঝলসে যায়। মসজিদের ভিতরে প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলে রাস্তার পাশে থাকা পথচারীরাও আহত সহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপরেই এলাকাজুড়ে আতংক ছড়িয়ে পরে।পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় মসজিদের ভিতরে ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোকে একে একে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে এবং গুরুতর আহতদের ঢাকাস্থ শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে মাত্র তিন জন সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারলেও মসজিদের ভিতরে থাকা মুসুল্লিদের ৩৪ জনের একে একে জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সারা দেশ সেদিন শোকে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এক সাথে এত মৃত্যুর ঘটনায়।