
শিক্ষা জাতির জীবন শক্তিকে স্থিতিশীল করে। শিক্ষা সকল ধরনের উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষা একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের শক্তিশালী হাতিয়ার। উন্নত জীবন যাপন ও সমাজের অগ্রগতি সাধনে শিক্ষার ভূমিকা অনন্য। শিক্ষা মানুষকে পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী করে তোলে। শিক্ষা ব্যক্তির সহজাত ক্ষমতা, গুণাবলি এবং সৃজনশীল সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষা মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ জানতে ও বুঝতে সহায়তা করে। কর্তব্যজ্ঞান, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, মানুষে মানুষে মৈত্রী বন্ধন ইত্যাদি গুণ অর্জনে শিক্ষা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং পরিণামে প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। তাই নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে জনগণের প্রত্যাশা থাকবে অপরিসীম।
মানুষ দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করে থাকে। প্রত্যেক জাতির পরিচয় ফুটে ওঠে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। আর সেই জাতির শিক্ষা যদি হয় নোঙ্গরবিহীন নৌকার মতো, তাহলে জাতির দিকনির্দেশনা কেমন হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তেমনি বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নোট বা গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রকাশক বা লাইব্রেরির মালিকরা করে আসছে গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা। এই বইয়ের ব্যবসা করে তারা হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তাই শিক্ষার্থীরা আজ গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। যেটাকে আমরা মুখস্থ বিদ্যা বলে থাকি। এই মুখস্থ বিদ্যা থেকে ছাত্রছাত্রীদেরকে বের করে আনতে সরকার নতুন এক শিক্ষা পদ্ধতির যুগে প্রবেশ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাকে কখনোই মুখস্থ বিদ্যা আর পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার কারণে শিক্ষাজীবনের বেশিরভাগ জ্ঞান কর্মজীবনে তেমন কাজে আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আর পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির বাস্তবতা সামনে রেখে শিক্ষা ব্যবস্থার খোলস বদলে ফেলা হচ্ছে। প্রবর্তন করা হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি। নাম ‘অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতি’। তবে নতুন এই শিক্ষাপদ্ধতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো- এটাই যদি শিক্ষা ব্যবস্থার উৎকৃষ্ট পন্থা হয়, তাহলে এতটা বছর ধরে শিক্ষার্থীদের ওপর কেন ভুল শিক্ষানীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। তাহলে যুগ যুগ ধরে যে শিক্ষানীতি চালু ছিল সেটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল। নাকি আমাদের জ্ঞানের অভাব।
উন্নত দেশগুলোতে বহু আগে থেকে কর্মমুখী ও গবেষণাধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মাধ্যমিকের প্রতিটি শ্রেণিতে তাদের কারিগরি বা ভোকেশনাল শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এর ফলে লেখাপড়া শেষ করে কাউকে বেকার থাকতে হয় না। তাহলে আমরা কেন কর্মমুখী ও গবেষণাধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারলাম না।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের কোর কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসাবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ‘নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছেÑ ক্লাসরুমে শেখা ও শেখানো। মূল্যায়নে পরীক্ষার বদলে সারা বছর ধরে নিরীক্ষা ও তদারকি (মূল্যায়ন) এবং ব্যতিক্রমী পাঠ্যবই। পহেলা জানুয়ারি থেকে তিনটি শ্রেণির শিশুদের হাতে যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে সেটা মুখস্থনির্ভর নয়। প্রত্যেকটি বই একেকটি রিসোর্স বুক। এতে পাঠের তথ্য শিক্ষার্থীরা কিভাবে সংগ্রহ করবে তা উল্লেখ আছে। শিক্ষকরা আগের মতো শিক্ষার্থীদের মুখস্থ রীতি গ্রহণ করবেন না এটা যেমন প্রত্যাশা তেমনি আবার শেখার জন্য শিশুকে শিক্ষকের কাছে বা নোট-গাইডের ওপর নির্ভর করতে হবে না, এটাও আশা করছি। শিক্ষার্থীরা শিখবে নিজের সহপাঠী, পরিবার ও সমাজ থেকে। শিক্ষক এখানে শুধু সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।’ নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষকরা কি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন? নাকি তারা এটাকে কোচিং বা প্রাইভেটের নতুন বাণিজ্যিক রূপ দেবেন এটাও ভেবে দেখা জরুরি।
অর্থবহ ও কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা ২০-৩০ বছর আগে চালু করতে পারলে দেশের চেহারা পালটে যেত। শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির অভাব হতো না। দেশে চাকরির সংস্থান না হলে অনায়াসে বিদেশের শ্রম বাজারে ভালো বেতনে চাকরি করতে পারত বলে মনে করি।
নতুন এই পদ্ধতিতে কোনো কিছু না বুঝে পাস করার জন্য শিক্ষার্থীকে আর তোতা পাখির মতো মুখস্থ করতে হবে না। যা জানবে, সেটা বুঝে প্রয়োগ করবে। এর ফলে তার দক্ষতা বাড়বে। দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ কোনো কিছু বোঝার জন্য তা ইতিবাচকভাবে নেয়া দরকার। এতে তার সার্বিক বিকাশ ঘটবে। এক কথায়, নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি সামাজিক, মানসিক, একাডেমিক বিকাশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এটি কর্মক্ষম মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে, যাতে তারা আবিষ্কার বা সৃষ্টি করার মতো মানুষ হিসাবে বিকশিত হবে। এটি শিক্ষার্থীকে তার কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতেও ভূমিকা রাখবে। সবমিলে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা বিকাশে ভূমিকা রাখবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতিতে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রথাগত পরীক্ষা থাকছে না। সারা বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হবে। কোনো সামষ্টিক বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষা হয় নবম-দশম শ্রেণিতে দুই বছরে পাঠদানের ওপর। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির লেখাপড়ার ওপর এসএসসি পরীক্ষা হবে। নবমে স্কুলেই মূল্যায়ন করা হবে। অপরদিকে এইচএসসি পরীক্ষা বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির লেখাপড়ার ওপর করা হয়ে থাকে। কিন্তু নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী একাদশ ও দ্বাদশে দুবার পরীক্ষা হবে। দুটির ফল মিলিয়ে এইচএসসির ফল দেওয়া হবে। বর্তমানে এই পদ্ধতি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি এবং বিদেশি শিক্ষাক্রমের ইংলিশ মিডিয়ামে চালু আছে। এই মূল্যায়নের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিখনকালীন মূল্যায়ন’। ফলে কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা থাকবে না। অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমে কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।
নতুন এই শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে এটা বারে বারে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আগামী বছর চালু হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালু হবে।
সরকার বর্তমানে যে শিক্ষাপদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে এটা শিক্ষা ব্যবস্থার একটি ভালো দিক। এই শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল। এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। এ বিষয়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে কোনো শিক্ষার্থীকে যেন অসুবিধায় পড়তে না হয়। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষকরা যেন বাণিজ্যিকীকরণ করতে না পারে সেদিকে সরকারকে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। দেশের সার্বিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য দক্ষ, উৎপাদনক্ষম জনশক্তি গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের। তার জন্য সরকারকে শিক্ষার ওপর বেশি নজর দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে দেশপ্রেম, মানবতা, নৈতিক মূল্যবোধ, কায়িক শ্রমে মর্যাদাদান, নেতৃত্ব ও সংগঠনের চারিত্রিক গুণাবলি, সৃজনশীলতা, সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি সবকিছুর বিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। এটা সবাই না বুঝলে শিক্ষার নতুন রীতি অর্থবহ হবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট