• ঢাকা
  • শনিবার:২০২৩:সেপ্টেম্বর || ০০:০৩:৩০
প্রকাশের সময় :
মে ২০, ২০২২,
৬:৫১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ২০, ২০২২,
৬:৫১ অপরাহ্ন

১০৫ বার দেখা হয়েছে ।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী: সংবাদ-সাহিত্যের বরপুত্র

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী: সংবাদ-সাহিত্যের বরপুত্র

এম. নজরুল ইসলাম

তরুণবেলায়, সেই ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সমান প্রতিবাদী ছিলেন তিনি। যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তার কলম। দুই চোখজুড়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রচলিত সংবাদভাষ্য ও সাহিত্যের ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দেশের সংবাদপত্রে তার কলাম সৃষ্টি করে নতুন এক ঘরানা। সাহিত্য দিয়ে যার লেখালেখি শুরু, তিনি হয়ে ওঠেন সংবাদ-সাহিত্যের বরপুত্র।
গাফ্‌ফার ভাই চলে গেলেন! আর কখনও তার ফোন পাব না। কোনোদিন আর ফোন করা হবে না তাকে। তিনি আর বলবেন না, ‘নজরুল, দেশের খবর কী বলো?’ তাকে ফোন করলে তিনি প্রথমেই জানতে চাইতেন দেশের খবর। সব ঠিক আছে তো? বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাদের খোঁজ নিতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ছিল তার অগাধ আস্থা। একান্ত আলাপচারিতায় বলতেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই।

তার সঙ্গে কত শত স্মৃতি। ২০০৪ সালে আমার জীবনের একটি বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে একদিন ফোনে বললেন, ‘এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তুমি পত্রিকার জন্য একটা প্রবন্ধ লেখ। ডাকযোগে আমার কাছে পাঠাও। আমি দেখে ঠিক করে দেব। তারপর তা তুমি পত্রিকায় পাঠাবে। ওরা ছাপাবে।’

তার কথায় আমি লিখেছিলাম। তিনি দেখে একটু যোগ-বিয়োগ করে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আমি তা ফ্রেশ করে লিখে ঢাকা ও লন্ডনের পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। ছাপা হয়। তারপর আরও পাঁচটি প্রবন্ধ তিনি দেখে দিয়েছিলেন। এরপর আর দেখে দিতে হয়নি। তার প্রেরণা ও আশীর্বাদে এখন আমি পত্রিকায় নিয়মিত লিখে যাচ্ছি। তার কাছে আমার অন্তহীন ঋণ।

দুই যুগেরও বেশি প্রায় প্রতিদিন তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। হাসপাতালে তার ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন থাকত না। তিনি নার্সের সহায়তায় ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে আমাকে প্রতিদিন ফোন করতেন। গত ১৮ মে বুধবার রাতেও তিনি আমাকে ফোন করেছেন। কথা হয়েছে। ১৯ মে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে খবর পেলাম তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন।

শৈশবে, যখন থেকে একুশের প্রভাতফেরিতে যাচ্ছি, তখন থেকেই তার নামের সঙ্গে পরিচয়। কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সেই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তার স্কুল জীবনেই। স্কুলের পাঠ নিতে নিতেই নিয়েছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির পাঠ। আধুনিকমনস্ক মানুষটি মননে ছিলেন প্রগতিশীল। তরুণবেলায়, সেই ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সমান প্রতিবাদী ছিলেন তিনি। যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তার কলম। দুই চোখজুড়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রচলিত সংবাদভাষ্য ও সাহিত্যের ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দেশের সংবাদপত্রে তার কলাম সৃষ্টি করে নতুন এক ঘরানা। সাহিত্য দিয়ে যার লেখালেখি শুরু, তিনি হয়ে ওঠেন সংবাদ-সাহিত্যের বরপুত্র।

অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন সৃজনশীল আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী, সঙ্গীও। ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্ম। এই ইতিহাসের অনেক কিছুরই সাক্ষী তিনি। জন্মেছিলেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে, ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি প্রয়াত হাজী ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তার বাবা, মা জোহরা খাতুন। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা ও উলানিয়া করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও। ছাত্রজীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫২ সালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়িও ছাত্রজীবনেই। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন ১৯৫৬ সালে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভূমিকাও পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।

বাংলাদেশে সেলিব্রিটি সাংবাদিকের সংখ্যা হাতেগোনা। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী সেই স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিকের একজন, যার কলামের অপেক্ষায় থাকত দেশের সিংহভাগ পাঠক। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী কলামে যে মতপ্রকাশ করতেন, তার সঙ্গে অনেক পাঠকেরই হয়ত মতের মিল হতো না। কিন্তু তিনি কী লিখছেন, কী ভাবছেন, তা জানার আগ্রহ পাঠকদের ছিল। এমনকি তার বিরুদ্ধ-রাজনৈতিক মতবাদের মানুষও আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর কলাম পড়তেন সমান আগ্রহে। সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। কলামের প্রতিটি শব্দে ছিল অসম্ভব চৌম্বক শক্তি। পাঠককে ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা এমন কজনের আছে? আইন পেশায় একটা কথা আছে, ‘ক্যারি দ্য কোর্ট’। পাঠককে টেনে রাখার অসম্ভব শক্তি ছিল তার কলমে। প্রযুক্তি এগিয়েছে; কিন্তু তিনি হাতে লিখতেন। মুক্তোর মতো স্বচ্ছ হাতের লেখা। টানা লিখে যেতেন পাতার পর পাতা। কোথাও কাটাকাটি নেই। অসামান্য দক্ষতায় নির্মেদ গদ্যে যেন সময়ের ছবি আঁকতেন সংবাদ-সাহিত্যের এক অসামান্য শিল্পী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।

ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি কলেজের ছাত্রজীবন থেকে। চিনি বলতে দূর থেকে দেখেছি। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ কিংবা সাহস হয়নি তখন। সামনাসামনি জানাশোনা আমার প্রবাস জীবনের শুরুতেই। তখন থেকেই তার সান্নিধ্য পেয়ে আসছি। তিনি লন্ডনে, আমি ভিয়েনায়। ব্রিটেন ও অস্ট্রিয়া, ইউরোপের দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব যতই থাক না কেন, দিনে দিনে নৈকট্য বেড়েছে। একুশের প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুঁচে যেতে সময় লাগেনি। একসময় যাকে খুব দূরের বলে মনে হতো, তিনি আমাকে অপত্য স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছেন। তার স্নেহ-সাহচর্যে আমি ঋদ্ধ। আজ এত বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আমাদের স্নেহে ভাই সহজ-সরল একজন মানুষ, যিনি সবাইকে আপন করে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখেন। তার সঙ্গে দেশের ভালো-মন্দ, রাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হতো, এ আমার অনেক বড় পাওয়া।

লন্ডনে গেলে তার সঙ্গে দেখা করা ছিল আমার নিত্য রুটিন। বিদেশেও অনেক জায়গাতে গিয়েছি তার সঙ্গে। ভিয়েনাতে এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন তিনি, এ আমার অনেক বড় পাওয়া। মনে আছে, ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছিল ভিয়েনায়। হল-ভর্তি দর্শক বিস্ময়-বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছিল নাটকটি। বোধহয় সেটাই ছিল লন্ডনের বাইরে পলাশী থেকে ধানমণ্ডি নাটকের প্রথম প্রদর্শনী।

দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের কাছে অতি পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রতিক্রিয়াশীলদেরও জানা ছিল এই মানুষটি যেকোনো মুহূর্তে গর্জে উঠতে পারেন। বাংলা সাহিত্যেও তার অবদান উপেক্ষা করার নয়।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার লেখায় পাঠককে দিতেন চিন্তার খোরাক। অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে তার মতো প্রগতিশীল মানুষকে আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আরও অনেক দিন লিখবেন, সক্রিয় থাকবে তার কলম ও চিন্তার জগৎ। আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো না। অনন্তের পথে পাড়ি জমালেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। বিদায় নিলেন এক অসামান্য গল্প-কথক। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

লেখক: সভাপতি, সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ। অস্ট্রিয়া-প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক